বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের সম্ভাবনা নিয়ে আপনার অভিমত কী?
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি সুযোগ যদি দেখি তাহলে অসাধারণ। ২০ কোটি মানুষের হাফ আ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির দেশ। এখানে সম্ভাবনা আর সুযোগের অভাব নেই। তবে বলতে পারি, আমাদের কার্যক্রম ব্যবস্থা (প্রসেস সিস্টেম) অতটা উন্নত নয়। আমরা খুবই রেগুলেটেড (নিয়ন্ত্রিত) একটা দেশ। এখানে একটা বিনিয়োগ আনতে যে ধরনের প্রতিযোগিতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়, যা দুবাই-সিঙ্গাপুরের মতো দেশে হয় না। ওইসব দেশে ১৫ মিনিটের মধ্যে বিনিয়োগকারী কোম্পানি তৈরি করে ফেলতে পারি। সিঙ্গাপুরে এক সপ্তাহে আইনি বিষয়গুলো সম্পন্ন করা সম্ভব হয়। আমাদের এখানে এত দ্রুত একটা কোম্পানি তৈরি সম্ভব? আমি একজন বিনিয়োগকারীর কথা জানি, কোম্পানিটি রিটেইল সার্ভিসের। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি আমার সঙ্গে এক বছর আগে দেখা করে গেছে। এখনো আরজেএসসিতে (যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তর) ঘোরাঘুরি করছে। এ রকম বহু উদাহরণ আছে। আমরাই কিন্তু আমাদের বড় প্রতিবন্ধকতা। বিনিয়োগ সহজীকরণের জন্য বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান ও এনবিআরের চেয়ারম্যান এখন অনেক কিছু নিয়ে আসছেন। তাদের উদ্দেশ্যের সঙ্গে আমাদের কোনো তফাত নেই। গভর্নর, এনবিআর চেয়ারম্যান, বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যানের ঐকমত্যে হওয়া কোনো একটা সিদ্ধান্ত যখন প্রয়োগ (অপারেশন) পর্যায়ে যায় তখনই জটিলতা দেখা যায়। এ বিষয়গুলো ধীরে ধীরে আমাদের সংস্কার করতে হবে। বিডায় এখন একটা রিলেশনশিপ টিমও তৈরি করা হয়েছে। এগুলো বিনিয়োগ আনার সঠিক পথ।
বর্তমান উদ্যোগগুলোর মাধ্যমে ইতিবাচক কোনো দিক দেখছেন কিনা?
ইতিবাচক দিকের কথা যদি বলি বিডা যে পরিবর্তনগুলো করছে এগুলো খুবই ভালো চিন্তা। এনবিআরও সম্প্রতি বেশকিছু পরিবর্তন এনেছে। তবে এসব পরিবর্তনের প্রভাব ফলপ্রসূ হচ্ছে কিনা সেটা আরো সময় গেলে বলা যাবে। যেমন অথরাইজ ইকোনমিক অপারেটর একটি অসাধারণ ধারণা। কিন্তু এটা যখন প্রয়োগ করতে যাই তখন হয় না, কারণ ব্যবস্থাটিই ওই রকম। এটাকে ব্যবহার উপযোগী করতে হবে। কাস্টমসের ভূমিকা প্রসঙ্গে বলতে গেলে বলতে হয় কাস্টমসের কাজ ট্যাক্স সংগ্রহ না। ব্যবসার সুযোগ-সুবিধা (ফ্যাসিলেট) নিশ্চিত করা এবং দ্রুততার সঙ্গে তা করা। দেখা যায় এইচএস কোড নিয়ে কাস্টমসে নিয়মিত সমস্যা তৈরি হয়। এসব বিলম্বিত প্রক্রিয়া থেকে বেরিয়ে গড়ে পাঁচটার জায়গায় ৫০টা কনটেইনারের কার্যক্রম সম্পন্ন করতে পারলেই তো রাজস্ব আহরণ বাড়ানো সম্ভব। যদি পাঁচটা কনটেইনার আটকে রেখে তিন মাস ধরে হয়রানি করা হয় তাহলে স্বাভাবিকভাবেই লোকজন চলে যাবে। এ রকম তো অনেক হয়েছে। আমাদের ভ্যাট বা মূল্য সংযোজন কর বেশ জটিল। যদিও ২০১২ সালের মূল আইনটিতে ওয়ান সিঙ্গেল ইউনিফায়েড (একক ও সমন্বিত) ভ্যাট ছিল। এর জন্য আমরা ব্যবসায়ীরাই দায়ী। ২০১২ সালের আইনটি সঠিক ছিল, আমরা সেটা বাস্তবায়ন করতে পারিনি।
বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ ত্বরান্বিত করতে গত এক বছরে কী এবং কোন ধরনের পদক্ষেপ নেয়া উচিত ছিল?
প্রথমত, সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এনবিআরের ডিজিটাইজেশন করা। ভ্যাট, ইনকাম ট্যাক্স ও কাস্টমস ডিজিটাইজেশন প্রক্রিয়া, এ ক্ষেত্রগুলোর গুরুত্বসহকারে উল্লেখযোগ্য উন্নতি হওয়া উচিত ছিল। এ তিনটির মধ্যে পারস্পরিক সংযোগও দরকার ছিল। কোনো কারণে হয়তো হয়নি। দ্বিতীয়ত, বিডায়ও আরো বোল্ড রিফর্ম বা দৃঢ় সংস্কার প্রয়োজন ছিল। একজন বিনিয়োগকারী এলে বিডা যেন তাকে সমস্ত কিছু দিয়ে দিতে পারে। ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে একজন বিনিয়োগকারীর দরকার হয় জমি, বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস। এ সবকিছুর প্রক্রিয়াগুলো বিডায় সম্পন্ন হওয়ার ব্যবস্থা প্রয়োজন ছিল। এ ধরনের ব্যবস্থা উন্নয়নে বিডা অনেক দূর গেছে, কিন্তু পুরোপুরি হয়নি। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং দরকারি। তৃতীয়ত, বাংলাদেশ ব্যাংকে অসাধারণ কিছু কাজ হয়েছে, কিন্তু একটি বিষয় আমাদের মোকাবেলা করতে হবে। আমার ব্যক্তিগত মতামত, কিছু কিছু ব্যাংক বাদ দেয়া দরকার ছিল। কারণ রাজনৈতিক সরকারের পক্ষে এটা করা কঠিন। ব্যাংক বাদ দেয়া মানে কিছু লোকজনের জামানত চলে যাওয়া। কিন্তু টেকনিক্যালি ব্যাংকগুলো ব্যর্থ, এদের কাছে টাকা নেই। কাঠামোগতভাবে এগুলো ব্যর্থ ব্যাংক। এগুলো বাদ দিয়ে ভিত্তিটা ক্লিন করা দরকার ছিল। ভারতের দিকে তাকান, দেখবেন তাদের ব্যাংকের সংখ্যা বাংলাদেশের অর্ধেক। তাদের অত বড় অর্থনীতির জন্য এত কম ব্যাংক। যদি কিছু ব্যাংক বাদ দেয়া হতো তাহলে এখানে অন্যদের আত্মবিশ্বাস আসত। আরেকটা হতে পারত বিএসইসিতে (বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন) পরিবর্তন দরকার ছিল।
যেগুলো হওয়া উচিত ছিল, সেগুলো কেন হলো না?
যেসব কাজ করা উচিত ছিল, সেগুলো করার লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য সবারই ছিল এবং আছে। কিছু বিষয়ের ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াটা চ্যালেঞ্জ, কিছু ক্ষেত্রে আমলাতন্ত্রের চ্যালেঞ্জ আছে। দৃঢ়তার সঙ্গে পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও সেটার তো আবার একটা প্রতিক্রিয়াও আছে। খুব সহজে বলে দিচ্ছি ব্যাংক বাদ দেয়া উচিত ছিল। কিন্তু বাস্তবে ব্যাংক বাদ দিলে এখন যদি এক লাখ লোক রাস্তায় নেমে আসে সে পরিস্থিতি সামলানো সম্ভব হবে কি? ব্যাংকগুলোকে বাদ দেয়ার এ চ্যালেঞ্জ রাজনৈতিক সরকার নেবে বলে আমার মনে হয় না। তাই আমাদের বাস্তবতাটাও দেখতে হবে।
বেজা, বেপজাসহ আরো কিছু ইনভেস্টমেন্ট প্রমোশন এজেন্সি একীভূত বিষয়ে আপনার অভিমত কী? এ রূপান্তর কি বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণে নতুন করে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে? কারণ এরই মধ্যে বেপজার বিদেশী বিনিয়োগকারীরা আপত্তি জানিয়েছেন।
এখানে দেখতে হবে যে বিনিয়োগকারীদের যেন কোনো সমস্যা না হয়। এক্ষেত্রে আমার ধারণা সিনার্জির মাধ্যমে দক্ষতা বাড়াতে হবে। পাশাপাশি খেয়াল রাখতে হবে যে বেজা, বেপজায় যারা বিনিয়োগ করেছেন তাদের ওপর যেন কোনো প্রভাব না পড়ে।
বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে একজন বিদেশী বিনিয়োগকারী কেন আগ্রহ দেখাবে?
বিদেশী বিনিয়োগকারী বিনিয়োগের আগ্রহ দেখাবে বাংলাদেশের সম্ভাবনার কারণে। যার ভিত্তি হলো বাংলাদেশের জনসংখ্যা ও অর্থনীতির আকার। বিনিয়োগকারীকে আকৃষ্ট করার বড় একটা পূর্বশর্ত হলো ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশকে স্থিতিশীল রাখা; যা নিশ্চিত করে ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ একটা সম্পর্ক রাখতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে আমরা ছোট কিন্তু বড় আকারের অর্থনীতির দেশ। বিনিয়োগ আসার ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারী চান স্থিতিশীলতা। সেটা নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমানে মেরুকরণ (পোলারাইজেশন) সঠিক পথ নয়। আপনার ব্যক্তিগত সম্পর্ক থাকতে হবে। সবার সঙ্গে সম্পর্ক থাকতে হবে। এখন বৈশ্বিক দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ।
সরকারের প্রতি আপনার আহ্বান কী?
বিদেশী বিনিয়োগ আনতে হলে আমাদের দেশের একটা ইমেজ তৈরি করতে হবে। বাংলাদেশকে বিনিয়োগের একটি লক্ষ্যে পরিণত করতে হবে। বলতে হবে বিনিয়োগের জন্য কেন আমরা অসাধারণ দেশ। তৈরি পোশাক শিল্পে আমরা সেটি দেখিয়েছি। তবে এখন বৈচিত্র্য আনতে হবে। তাদের বলতে হবে আমরা দুনিয়ার দর্জি না। আমরা অনেক কিছু বানাতে পারি এটা দেখাতে হবে। আমরা উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন ম্যানুফ্যাকচারিং হাব হতে পারি। ম্যানুফ্যাকচারিং হলে আমাদের কর্মসংস্থান তৈরি হবে। এ মুহূর্তে কাজটা করা উচিত। ইমেজ তৈরি করতে হবে। বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান সে চেষ্টা করছেন, কিন্তু তার একার পক্ষে সম্ভব নয়। বাংলাদেশকে একটা ইতিবাচক লাইটে নিয়ে আসতে হবে।